গরিব মানুষের ঋণ পাওয়ার অধিকারকে মানবাধিকারের অংশ হিসেবে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, "গরিব মানুষের কর্মসংস্থান দরকার, শুধু টাকা নয়। কিন্তু অনেকে মনে করেন অর্থ চাকরির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমি বিশ্বাস করি, ঋণ পাওয়া একজন মানুষের মৌলিক অধিকার। যদি ব্যাংক গরিব মানুষকে ঋণ না দেয়, তবে কেন আমি তাদের জন্য নিজেই একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করবো না?"
বৃহস্পতিবার (৩ এপ্রিল) ব্যাংককের স্থানীয় সময় বিকেলে বিমসটেক সম্মেলনের সাইডলাইনে অনুষ্ঠিত ‘বিমসটেক ইয়ং জেনারেশন ফোরাম: হোয়্যার দ্য ফিউচার মিটস’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য প্রদানকালে তিনি এসব কথা বলেন।
ড. ইউনূস বলেন, "আমি ১ ডলার ঋণ দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম, যা পরবর্তীতে গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম দেয়। অনেক বাধা এসেছে, অনেক সময় লেগেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি গ্রামের দরিদ্র মানুষের জন্য একটি ব্যাংক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি।"
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, "আমি যখন গ্রামের দরিদ্র মানুষকে ঋণ দিতে চাই, তখন প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা আমাকে হতাশ করে। ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, গরিব মানুষকে ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়। আমি তাদের বললাম, ব্যাংকের মূলনীতি পুরোপুরি ভুল। সমাজের যাদের কিছুই নেই, তাদের ঋণ দেওয়াই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু ব্যাংকগুলো বরং ধনীদের আরও বেশি ঋণ দিয়ে থাকে।"
তিনি আরও বলেন, "আমার দেওয়া প্রথম ঋণ একজন নারীর কাছে গিয়েছিল, যিনি ঋণ শোধ করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। তার কাজের সব মুনাফা ঋণদাতারা নিয়ে নিত। আমি তাকে সামান্য অর্থ দিয়েছিলাম, যাতে তিনি নিজেই তার পণ্য বাজারে বিক্রি করতে পারেন। এতে তার জীবন বদলে যায়।"
ক্ষুদ্র ঋণের কার্যকারিতা ব্যাখ্যা করে ড. ইউনূস বলেন, "দান করলে একবারই দেওয়া হয়, সেটি আর ফেরত আসে না। কিন্তু ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দেওয়া অর্থ বারবার ব্যবহার করা যায়। এটি বারবার ঘুরিয়ে লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব।"
তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, "তরুণদের চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই কেবল টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।"
বিমসটেক ইয়ং জেনারেশন ফোরামে কী-নোট স্পিকার হিসেবে বক্তব্য প্রদানকালে তিনি তরুণদের উদ্দেশে বলেন, "তুমি রাতারাতি সবকিছু বদলে দিতে পারবে না। ছোট পরিসরে শুরু করো, তারপর ধাপে ধাপে বড় হও। বড় পরিসরে ব্যবসা শুরু করাটা ভুল পথে এগোনোর শামিল।"
তিনি সকলকে সামাজিক ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান এবং বলেন, "সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে শুধু আর্থিক লাভ নয়, বরং সমাজের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।"
ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বিমসটেক সম্মেলনে বক্তব্য প্রদানকালে ড. ইউনূস মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পে প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, "এই ঘটনা আমাদের দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে। প্রকৃতিকে বোঝার এবং দুর্যোগের ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য আমাদের আরও গবেষণা ও পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশও ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে, যদিও সৌভাগ্যবশত এখনো বড় কোনো বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়নি।"
সম্মেলনে বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর সরকার প্রধানদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেবেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, "বিমসটেকে আমার যাত্রা তরুণদের মাধ্যমে শুরু হওয়ায় আমি আনন্দিত। আমি সবসময় তরুণদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়ার চেষ্টা করি, যা আমাকে নতুন সম্ভাবনার পথে চলতে সহায়তা করে।"
তিনি আরও বলেন, "একটি নতুন দেশ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে আমি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ আমাকে নাড়া দেয়। মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা যাচ্ছিল, আমি তখন অনুভব করলাম, পুরো দেশের পরিবর্তন একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের পাশের একটি গ্রামকে নিজের বাংলাদেশ হিসেবে বেছে নিলাম এবং সেখানেই কাজ শুরু করলাম।"
ড. ইউনূসের এই বক্তব্য তরুণদের নতুন সম্ভাবনার পথ দেখানোর পাশাপাশি সামাজিক পরিবর্তনের জন্য উদ্যোক্তা হওয়ার গুরুত্বও তুলে ধরে।