সাধারণত ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্ককে বলা হয় প্রেসক্রিপশন সম্পর্ক। অর্থাৎ ডাক্তারের কাছে রোগীর পরিচয় শুধু পুরোনো একটা প্রেসক্রিপশনই বহন করে। যে কাগজটি পরম মমতা ও আশ্বস্ততার বন্ধনে রোগীরা সযত্নে নিরাপদে দীর্ঘ একটা সময় পাহারা দেয়। যদি সেই আশ্বস্ততা ও পরম মমতার বন্ধনটি থাকে দুর্বোধ্য, মানহীন ও অজানা আঁকাবুকি, তাহলে তা সত্যিই পীড়াদায়ক। দেশের অধিকাংশ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে হস্তলিখন এতটাই ঝলমলে দুর্বোধ্য যে, অনেক সময় প্রেসক্রিপশনের লেখা আবিষ্কার করতে গিয়ে ফার্মেসির বিক্রয়কর্মীদেরও মস্তিষ্কের কলকবজা হ্যাং হয়ে যায়। প্রেসক্রিপশন নিয়ে বাহারি আলোচনার শেষ নেই। ডাক্তারদের অস্পষ্ট ব্যবস্থাপত্র দেখে অনেকেই বলেন, চিকিৎসকরা ওষুধের সাইফার কোড বা এক ধরনের গোপন চিহ্ন ব্যবহার করেন, যাতে করে পার্টিকুলার ফার্মেসি ছাড়া অন্য কোন ফার্মেসি সেটা বুঝতে না পারে। আবার কারো কারো মতে, ডাক্তার ও ফার্মাসিস্টদের গোপন আন্ডারস্ট্যান্ডিং হলো এই প্রেসক্রিপশন। চিকিৎসকদের কাছ থেকে লিখিত দুর্বোধ্য প্রেসক্রিপশন কোনোভাবেই কাম্য নয়। অস্পষ্ট ব্যবস্থাপত্র শুধু বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা নয় বরং এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। ডাক্তারদের হাতের লেখা বুঝতে না পারায় ও ভুল ওষুধ সেবন করায় প্রতিবছর ১৫ লাখ রোগী অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব মেডিসিন (আইওএম)-এর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, চিকিৎসকের ভুলের কারণে বিশ্বে বছরে সাত হাজার রোগী মারা যায়। ওষুধ দিতে ভুল নয়, হাতের লেখার কারণে ঘটছে এ বিপত্তি। প্রেসক্রিপশনে ডাক্তারদের হাতের লেখার অস্পষ্টতা নিয়ে নানা রকম রসিকতা চালু রয়েছে বাজারে। তবে, ডাক্তারদের হাতের লেখা খারাপ হওয়ার পরিণাম যে এত মারাত্মক হতে পারে তা বোঝা যায়নি। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী দেশে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার নিবন্ধিত ফার্মেসি রয়েছে। এগুলো ছাড়াও আরো কয়েক লাখ অনিবন্ধিত ওষুধের দোকান রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। অথচ বেশিরভাগ ফার্মেসিতে বিক্রয় প্রতিনিধি অষ্টম শ্রেণি, এসএসসি কিংবা এইচএসসি পাস। ডাক্তারদের অস্পষ্ট প্রেসক্রিপশন যেখানে অন্য ডাক্তাররাই অনেক সময় বুঝতে পারেন না, সেখানে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ কিংবা স্বল্পশিক্ষিত বিক্রয়কর্মী সেটা কীভাবে বুঝবেন? উচ্চ আদালতের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে যে, প্রেসক্রিপশন স্পষ্টাক্ষরে ‘পড়ার উপযোগী করে’ লিখতে হবে। জেনেরিক নামসহ ব্লক লেটার বা প্রিন্ট করার মাধ্যমে প্রেসক্রিপশন লেখার আদালতের নির্দেশটিও আমাদের বেশিরভাগ চিকিৎসক মেনে চলেন না। চিকিৎসকদের জনস্বার্থে কিংবা অন্তত আদালতের নির্দেশ মানার জন্য হলেও প্রেসক্রিপশন স্পষ্টাক্ষরে ব্লক লেটারে লিখতে হবে। যে-সব ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্ট নেই সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সচেষ্ট হতে হবে, প্রয়োজনে প্রশাসনের তদারকি বাড়াতে হবে।