সচেতনতা ও সেবকবিহীন ভূমিকম্প

মোমিন মেহেদী : | প্রকাশ: ১৬ মার্চ, ২০২৫, ০৭:৪৩ পিএম
সচেতনতা ও সেবকবিহীন ভূমিকম্প
মোমিন মেহেদী

যখন সারাদেশে শিক্ষার্থী- তৌহিদী জনতা আর নতুন দলের রাজনীতিকদেরকে দেখছি, তখন জনতা খুঁজছে সেবক। কোথায় আমরা সেবক পাবো? বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে এমন প্রশ্ন নিয়ে চিন্তিত অবস্থায় চোখের পাতা বন্ধ হলেও প্রতিদিন ঘুম ভাঙ্গে চরম রকম শঙ্কার মধ্য দিয়ে। কারণ হিসেবে বলতে পারি- বাংলাদেশের রাজনীতি-কূটনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক সংকটকালে নতুন খবর ‘ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বিশ্বের এমন ২০টি শহরের মধ্যে রাজধানীর ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়।’ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বড় মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে বেশি দেরি নেই। একটি বড় মাত্রার ভূমিকম্প ঘটে যাওয়ার ১০০ বছর পর ফের বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে একশ’ বছর পূর্ণ হওয়ার ২০ বছর আগে হলে পূর্বের মাত্রার চাইতে কম মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয়, আর ২০ বছর পরে হলে তার মাত্রা আগের চেয়ে বেশি হয়।২০১৮ সালে সেই একশ’ বছর পূর্ণ হয়েছে, এরপর আমরা পার হয়েছে আরো ৫ বছর। তাই যেকোনো সময় বড় মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগে ১৯১৮ সালে বাংলাদেশে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল।২০০৯ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের দেশে ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পরবে এবং ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঢাকা শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। টাঙ্গাইলের মধুপুরসহ দেশের ১৩টি স্থান অধিক ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা, এই বিষয়টিও মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে। সেই সাথে আতঙ্কময় আগামীর কথা হলো- প্রিয় শহর, এগিয়ে চলার শহর হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত ঢাকা শহরের ৭৬ শতাংশ রাস্তা সরু হওয়ায় ভূমিকম্প হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন হয়ে যাবে। রাস্তাগুলো যেমন সরু, তেমন ২৪ শতাংশ রাস্তা নরম মাটি দিয়ে তৈরি। ঢাকা শহরে ভূমিকম্প হলে ফ্লাইওভার ব্রিজ ভেঙে পড়বে, ভেঙ্গে পড়বে বাংলাদেশের মানুষের কথা না ভেবে কেবল তথাকথিত উন্নয়নের নামে নির্মিত ফ্যাসিস্ট সরকার আমলের মেট্রোরেলের অধিকাংশ স্থাপনা, বিদ্যুৎ-গ্যাস লাইনে আগুন ধরে যাবে, পানির লাইন ফেটে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে উদ্ধার কার্যক্রম চালানোও কঠিন হয়ে উঠবে। ঢাকা শহরে অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যা অনেক বেশি। এখানে ভবনগুলো অপরিকল্পিত। তাই ভূমিকম্প হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটির ওপর আরেকটি গিয়ে পড়বে, এতে বড় বিপর্যয় নেমে আসবে। 


প্রযুক্তিবিদদের তথ্যানুযায়ী- কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা যায়, এ অঞ্চলে ভূগর্ভে দুটি প্লেট ধাবিত হচ্ছে। ইন্ডিয়া প্লেট পূর্বদিকে যাচ্ছে। বার্মা প্লেট পশ্চিমের দিকে আসছে। বার্মা প্লেটের নিচে ইন্ডিয়া প্লেট তলিয়ে যাচ্ছে। এটিকে বলে ‘সাবডাকশান জোন’। জিপিএসে পরিমাণ করে দেখা গেছে, প্রতিবছর ১ মিটার থেকে দেড় মিটার সংকোচন হচ্ছে। সে হিসাবে এখানে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে। যে কোনো সময় এ ভূমিকম্প হতে পারে। সেই সাথে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে মাথায় রাখতে হবে- যেহেতু ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঢাকা নগরী। অপরিকল্পিত শহর এবং বিল্ডিং কোড মেনে অনেক স্থাপনা নির্মাণ না হওয়ায় এখানকার ১ শতাংশ বিল্ডিংও যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে দুই লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটবে। ৫-৭ লাখ মানুষ বিভিন্ন বিল্ডিংয়ে আটকা পড়বে। পরবর্তী সময়ে খাদ্যাভাব, অগ্নিকাণ্ডসহ নানা কারণে তাদেরও একটি বড় অংশের মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।একটি বড় ধরনের ভূমিকম্প থেকে আরেকটি বড় ভূমিকম্পের সময় এলাকাভেদে একেক রকম হয়। এ ভূখণ্ডে বড় ধরনের ভূমিকম্প সাধারণত এক থেকে দেড় হাজার বছর পরপর হয়ে থাকে। ১৭৬২ সালে ‘গ্রেট আরকান আর্থকোয়েক’-এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৫। এতে চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮৯৭ সালে আসামে সংঘটিত ভূমিকম্প ছিল ৮ দশমিক ৭ মাত্রার। এসব হিসাবেও বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। 


আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে এবং কাছাকাছি এলাকায় ৪১টি ভূমিকম্প হয়। গত বছর তা ছিল ৫৪। যদিও ২০০৮ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে দেশে ভূমিকম্প হলে তার জন্য প্রস্তুতি কেমন-এ বিষয়ে একটি কমিটি করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। সেই কমিটি এখন কাজ করছে। হাইকোর্টের আরেক নির্দেশনায় ভূমিকম্প হলে পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া হবে, কী কী যন্ত্রপাতি আছে, নগরীকে কীভাবে আবার আবাসযোগ্য করা হবে-সেসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এসব বিষয়ে এরই মধ্যে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। বর্তমানে ১২ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প চলমান আছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স, আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু এখন কি অবস্থা? অবস্থা খুব খারাপ, কারণ, ঢাকার ৮০% ভবনেই ঝুঁকিপূর্ণ। দেশে এখন যে লেডার আছে, তা দিয়ে বিশতলা পর্যন্ত ওঠা যায়। ৬২ হাজারের টার্গেট নিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৮ হাজার আরবান ভলান্টিয়ারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ হলে মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য।


এত জানার পর এসে সবার মনে প্রশ্ন আসছে যে, এখন কি করণীয়? উত্তরে বলছি- ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রস্তুতি অত্যাবশ্যক। এ জায়গায় এখনো ঘাটতি আছে। প্রস্তুতির চেয়ে ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধারে করণীয় এবং বিভিন্ন কেনাকাটায় মনোযোগ বেশি ছিলো আগের ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়। আশা করি- এই সময়ে এসে তা না করে- তারা নীতির সাথে ভয়ংকর ভূমিকম্পকে মোকাবেলা করবে। আর এ লক্ষ্যে ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় বেশি করে স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে, থানায়, কমিউনিটিতে স্বেচ্ছাসেবকরা যেন ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কাজে সহায়তা করতে পারে।


ভূমিকম্প বিষয়ক সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে গত ২৭ বছর ধরে কাজ করার সুবাদে জেনেছি ও বুঝেছি- বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষেরই ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার বিষয়ে কোনো শিক্ষা নেই। সচেতনতাবোধ নেই। সরকারের প্রস্তুতির অভাব। সরকারের প্রস্তুতি মূলত ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধারকাজে। এটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ভূমিকম্পের আগে ব্যক্তি পর্যায়ে, পারিবারিক পর্যায়ে, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কী কী থাকা দরকার, সেখানেও তেমন কোনো অর্থ ব্যয় নেই।


অতীত সকল সরকারের সময় কোটি কোটি টাকা বাজেট হলেও এর ১ শতাংশও এই বিষয়ে ব্যয় করেনি। অথচ যদি স্মার্টফোনে ন্যাচারাল হ্যাজার্ড গেম চালু করা হতো, তাহলে তিন থেকে ছয় মাস সময়ের মধ্যে সবাই এটি শিখে যেতো। আশা করি চলমান সরকারে দুর্নীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় না দিয়ে স্মার্টফোনে ন্যাচারাল হ্যাজার্ড গেম চালু করবে। এতে করে ভূমিকম্প হলে ঘরের ভেতরে থাকলে কী করতে হবে। কীভাবে আশ্রয় নিতে হবে, বাইরে থাকলে কী করণীয়-এসব শিখে নেবে। শিক্ষিত করার পর মহড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সেটি নিয়মিতভাবে হতে হবে। মানসিকভাবে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এটি। এ প্রস্তুতি না নিয়ে উদ্ধারকাজের প্রস্তুতি নিলে ভূমিকম্পেই যদি সব নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে উদ্ধার কে করবে। কোন এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মেডিকেল টিম, রেসকিউ টিম পাঠানো, রিলিফ পাঠানো-এসবেরও সঠিক ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা নিয়ে প্রস্তুত থাকবে। তবে সব কিছুর পাশাপাশি মনে রাখতে হবে যে, ময়নামতি পাহাড়ে বৌদ্ধ বিহারের যে স্থাপনা ওই এলাকা থেকে লোকজন অভিবাসন করে চলে গেছে ৮০০ থেকে ১,০০০ বছর আগে। তাদের এই অভিবাসনের সঙ্গে ভূমিকম্পের সম্পর্ক ছিল।


বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের ইতিহাস সবাইকে স্মরণ করিয়ে বলতে চাই- বাংলাদেশের সিলেট, চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় ১৫৪৮, ১৬৪২, ১৬৬৩, ১৭৬২, ১৭৬৫, ১৮১২, ১৮৬৫, ১৮৬৯ সালে ভূমিকম্প হওয়ার ঐতিহাসিক উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া ১৮২২ ও ১৮১৮ সালে সিলেট ও শ্রীমঙ্গলে ৭.৫ ও ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। অবশ্য এর ক্ষয়ক্ষতির তেমন বর্ণনা পাওয়া যায় না। এমন একটা দেশে বেশিরভাগই ভবন বিল্ডিং কোড না মেনেই নির্মাণ হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই সাথে ক্ষমতায় আসবার আর থাকবার চেষ্টায় ব্যস্ত না থেকে চলমান রাজনীতি সচেতন সকলেরই উচিত সতর্কতা অবলম্বন করা। খুব বেশি সতর্কতা এজন্য প্রয়োজন যে, জনসংখ্যার ঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণ, অপ্রশস্ত সড়ক অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির অভাবই এ ঝুঁকি তৈরি করেছে। মাঝারি থেকে প্রবল মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী। আর এই রাজধানীতেই আমরা গড়েছি আমাদের দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ স্বপ্নের আবাস। সবার আগে চাই এই বিষয়ে রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের সচেতনতা বৃদ্ধির ক্যাম্পেইন করা। তা না করে কেবলই ক্ষমতায় আসবার বা থাকবার চেষ্টা যারা করছেন, তাদেরকে কেন মানুষ ক্ষমতায় আনবে বা রাখবে? ভূমিকম্প প্রবণ শহরের বাসিন্দা হয়েও লিখছি-বলছি এবং সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছি ছাত্র জীবন থেকে। কারণ ক্ষমতায় আসবার জন্য নয়, জনতার কল্যাণের জন্য নিবেদিত থাকার চেষ্টা আমাদেরকে মানুষ হিসেবে বাঁচার প্রেরণা যোগায়। ফ্যাসিস্টদের বিদায়ের পর নতুন করে কোনো ফ্যাসিস্ট আসুক বা না আসুক ভূমিকম্প কিন্তু আসবেই। সেই কথা মাথায় রেখে গণমাধ্যমগুলোর পাশাপাশি সত্যিকারের দেশপ্রেমিকদেরকে ভূমিকম্প সচেতনতা তৈরিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোনো বিকল্প দেখছি না...


লেখক : মোমিন মেহেদী; চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW