ভুয়া প্রতিষ্ঠান ও স্বজনপ্রীতির মধ্য দিয়ে আপদকালীন প্রকল্পে দেয়া বরাদ্দে নয়-ছয় করা হয়েছে। পার্বত্য উপদেষ্টার বরাদ্দে বঞ্চিত হয়েছে মারমা, ত্রিপুরা ও বাঙ্গালিরা। সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়েছে খাগড়াছড়ির লক্ষ্ণীছড়ি উপজেলার বাঙ্গালীরা। ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে লক্ষ্ণীছড়িতে ২৯টি প্রকল্প দেয়া হলেও একটি প্রকল্পও বাঙ্গালীর নাম নেই। অধিকাংশ প্রকল্পই একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে। বঞ্চিত হয়েছে এখানকার মারমা জনগোষ্টিও। নামে মাত্র কয়েকজনের নাম রয়েছে তাও যতসামন্য। এই নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে উপজেলার সর্বত্র। প্রতিবাদের ঝড় ওঠেছে, প্রকল্প বাতিলের দাবিতে সভা-সমাবেশ চলছে জেলাশহরসহ উপজেলাগুলোতে। বৈসম্যমূলক এ প্রকল্প বাতিল করা না হলে হরতাল অবরোাধসহ নানা কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে বলেও সমাবেশে থেকে হুশিয়ার করা হয়।
এদিকে যতটা না লক্ষ্ণীছড়ি উপজেলা অবহেলিত তার চেয়ে বেশি অবহেলিত এখানকার বসবাসরত বাঙ্গালিরা। বিগত ১৫ বছর ধরে সৈরাচারি আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে তেমন কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন চোখে পড়েনি। নামেমাত্র বরাদ্দ আসলেও লুটপাট হয়েছে বেশিরভাগ বরাদ্দ। এছাড়াও পুরো জেলায় আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ছিল লাগামহীন ঘোড়া। ভুয়া প্রকল্পে সরকারি শতশত কোটি টাকা লুপাট হয়েছে এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে। ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এ অবস্থা পরিবর্তন হওয়ার আশা করা হলেও উল্টো যেন বেপরোয়া হয়েছে আরও বেশি। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে বর্তমান মেয়াদে দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টরা।
গত ২৫ মার্চ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়-১ শাখার উপ-সচিব মোহাম্মদ নাহিদ ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে, খাগড়াছড়ির ১’শ ৮৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাঝে ৩ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের অনুকূলে সহিসংতায় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সদস্যদের সার্বিক উন্নয়ন, চিকিৎসা ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে এ বরাদ্দ উল্লেখ করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে। ১’শ ৮৫টি প্রকল্পের অধিকাংশ ভুয়া প্রতিষ্ঠান, একই ব্যক্তি ও পরিবারকে একাধিক বরাদ্দ, স্বজনপ্রীতি, জেলা পরিষদ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দের চিত্র উঠে এসেছে।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা ত্রিনা চাকমা একাই ১২টি প্রকল্পে আবেদন করে সবগুলোতে ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন। নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নের নামে প্রকল্প ভাগিয়েছেন তিনি। এই ত্রিনা চাকমা ছিলেন আওয়ামীলীগ সরকারের আমলের সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাসহ একাধিক আওয়ামীলীগ শীর্ষ নেতার সহচর। চাকরিকালীন সময়ে এবং অবসর সময়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। এ ছাড়া জেলা শহরের সূর্য শিখা ক্লাবের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে আলাদা আলাদা বরাদ্দে ৫ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। বস্তায় চাষাবাদ প্রকল্পে দেয়া হয়েছে ১০ লাখ টাকা, অন্যের পুকুর দেখিয়ে একাধিক প্রতিষ্ঠান মৎস্য খাতে বরাদ্দ পেয়েছে, এছাড়া একই পরিবারকে চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য আলাদা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের কর্মকর্তার মাধ্যমে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতার বাবার প্রতিষ্ঠানে লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে তালিকার ২৭ নম্বরে থাকা খেজুরবাগান বিত্তহীন সমবায় সমিতি লি. এর সভাপতি নুরুচ্ছাফার মুঠোফোনে একাধিক বার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। বরাদ্দ পাওয়াদের অনেকে কখন কি নামে প্রকল্পের জন্য আবেদন করেছেন তার উত্তর দিতে পারেনি।
অপরদিকে তালিকার ৫৬ নাম্বারে দেখা যায়, ১নং লক্ষ্ণীছড়ি ইউনিয়নের সংরক্ষিত আসনের মহিলা মেম্বার মেরিনা চাকমার নামে ১০টি প্রকল্পে প্রতিটি সাড়ে ৭টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তালিকার ৫৭ নাম্বারে একই ইউনিয়রে সংরক্ষিত আসনের মহিলা মেম্বার কনিকা চৌধুরীর নামেও একই পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রকল্পগুলোর নাম দেখলেই মনে হবে ভুয়া। পৃথক ২টি বরাদ্দ কপিতে ২৯টি প্রকল্প নেয়া হলেও একটি প্রকল্প এখানকার বসবাসরত বাঙ্গাালিদের নাম নেই। যদিও ৩ভাগের একভাগেরও বেশি বাঙ্গালি এখানে বসবাস করে। এছাড়াও মারমাদের বড় একটি অংশ এ বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ২৯টি প্রকল্পর মধ্যে মাত্র ১৩৫ নাম্বারে বিনাইজুরি এলাকার সানুবাই মারমা ৩০হাজার টাকা ও তালিকার ১৬৪ নাম্বারে জুর্গাছড়ির মিঞাপ্রু মারমার নামে ৩০হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। তালিকায় আর কোথাও মারমার নাম পাওয়া যায় নি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান অংগপ্রু মারমা বলেন, বরাদ্দে চরম বৈষম্য করা হয়েছে। বাঙ্গালিদের পাশাপাশি মারমাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। লক্ষ্ণীছড়ি উপজেলা উল্লেখ্যযোগ্য বিশাল জনগোষ্টি রয়েছে মারমা। তাদের বাদ দিয়ে এমন একটি বরাদ্দ তালিকা মেনে য়ো যায় না। এই প্রকল্প বাতিলের দাবি জানান তিনি।
লক্ষ্ণীছড়ি গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা মো. সামশুল ইসলাম বলেন, পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ দেখে বাঙ্গালিরা হতাশ। লক্ষ্ণীছড়িতে জনসংখ্যার বড় একটি অংশ বাঙ্গালি কিন্তু কোনো বরাদ্দ রাখা হয় নি। যা অত্যন্ত দু:খজনক। এই তালিকায় শুধু বাঙ্গালি নয় এখানকার মারমা ও ত্রিপুরাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। আমরা এই বরাদ্দ বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। এ বরাদ্দ তালিকা বাতিল করা না হলে সাধারণ মানুষকে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে জানান তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে থেকে আপদকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় অর্থ বরাদ্দ শিরোনামে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর গত ২৬ শে মার্চ থেকে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অনেকে পোষ্ট করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।