একসময় হবিগঞ্জ জেলার প্রাণ ছিল সুতাং নদী। খরস্রোতা এই নদীর বুকে পালতোলা নৌকা চলত, জেলেরা মাছ ধরত, কৃষকেরা সেচের জন্য পানি ব্যবহার করত। কিন্তু দখল, দূষণ ও প্রশাসনিক অবহেলার কারণে নদীটি আজ প্রায় মৃত। একসময়ের টলটলে স্বচ্ছ পানি এখন কালো হয়ে গেছে, চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্গন্ধ। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এই নদীর এমন ভয়াবহ অবস্থার জন্য মূলত শিল্পকারখানাগুলোর অপরিশোধিত বর্জ্য দায়ী। হবিগঞ্জ সদর ও লাখাই উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুতাং নদীর দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান। নিয়ম অনুযায়ী এসব কারখানার বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) ব্যবহার করে দূষণমুক্ত করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা কার্যকরভাবে মানা হচ্ছে না। অনেক কারখানায় শোধনাগার থাকলেও তা কেবল দেখানোর জন্য, নিয়মিত চালু রাখা হয় না। ফলে কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ছে, যার ফলে পানির গুণগত মান চরমভাবে নষ্ট হচ্ছে। পানির সঙ্গে মিশে থাকা রাসায়নিক পদার্থ মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরও ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, দূষিত পানি শরীরে লাগলে চুলকানি ও নানা ধরনের চর্মরোগ দেখা দেয়। এমনকি গবাদিপশুও এই নদীর পানি পান করতে চায় না। নদীর এই অবস্থা শুধু স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্যই নয়, জীববৈচিত্র্যের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশীয় প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে, নদীর পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এ দূষণের পাশাপাশি সুতাং নদীর জন্য আরেকটি বড় সমস্যা হলো অবৈধ দখল। নদীর দুই পাড় দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে, যার ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এসব দখলদারদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান চালালেও তা দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমাধান দিতে পারেনি। প্রশাসনের একাংশের নিষ্ক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবের কারণে নদী আজ সংকটাপন্ন। সুতাং নদীকে রক্ষায় দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শিল্পকারখানাগুলোর বর্জ্য শোধনাগার ব্যবহারের বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে এবং নিয়ম না মানলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি, নদী পুনরুদ্ধারের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করা এবং স্থানীয় জনগণকে সচেতন করে তাদের সম্পৃক্ত করা। সুতাং নদী একসময় হবিগঞ্জবাসীর জীবন-জীবিকার অংশ ছিল। কিন্তু দখল, দূষণ ও অব্যবস্থাপনার কারণে আজ তা ধ্বংসের পথে। এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে একদিন এই নদী কেবল স্মৃতির অংশ হয়ে যাবে। তাই সরকারের উচিত দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে নদীটিকে তার পুরোনো গৌরব ফিরিয়ে দেওয়া। আমাদের সবাইকে বুঝতে হবেÑনদী বাঁচলে, দেশ বাঁচবে।