উপকূলীয় এলাকার চারদিকে থইথই করছে পানি। উপকূলে পানির অভাব নেই, চারদিকেই পানি। তবে সব নোনা। এ কারণে তা খাওয়ার অনুপযোগী। সুপেয় খাবার পানির বড়ই অভাব। উপকূল অঞ্চলের মানুষকে দিনের একটি বড় সময় ব্যয় করতে হয় খাবার পানি জোগাড় করতে। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের পান করাসহ দৈনন্দিন কাজের জন্য নির্ভর করতে হয় পুকুর ও বৃষ্টির পানির ওপর। খাবার পানি আনতে গিয়ে প্রতিদিন দুবারে ৪-৫ ঘণ্টা ব্যয় করতে হয় এ উপকূলের অধিকাংশ বাড়ির নারীদের। প্রতিদিন পানির জন্য এই পথ পাড়ি দিয়ে তাদের পানি আনতে হয়। তীব্র গরম পড়ার আগেই খাওয়ার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রীষ্মের দাবদাহ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সংকট আরও বাড়বে।
উপকূলের মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে বিশুদ্ধ পানির উৎস। নলকূপে নোনা পানি ওঠে। বৃষ্টির মৌসুমে অনেকে পানি ধরে রাখেন বড় ট্যাংকে। সেই পানি শেষ হয়ে গেলে শুরু হয় সুপেয় পানির সংকট। গরিব মানুষ তখন পুকুর ও ডোবার পানিতে ফিটকিরি অথবা ওষুধ দিয়ে বিশুদ্ধ করে পান করেন। রান্না, থালাবাসন ধোয়া, গোসলসহ আনুষঙ্গিক কাজ করতে হয় নোনা পানিতে। লবণাক্ততার এই আগ্রাসন শুধু ভূ উপরিস্থ পানির আধার নয়, ভূগর্ভস্থ উৎসেও ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে নানা রোগব্যাধি এ অঞ্চলের জনস্বাস্থ্যকে হুমকিতে ফেলছে। উপকূলে বিশুদ্ধ পানির কষ্ট প্রকট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিশুদ্ধ পানির জন্য গ্রামের বাসিন্দাদের ছুটতে হচ্ছে দূরদূরান্তের উৎসে।
সাধারণত শীতের মৌসুম থেকে বর্ষা আসার আগপর্যন্ত একটা লম্বা সময় এই দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এ উপকূলবাসীর। বাড়ির নলকূপে পানি ওঠে না। রান্নাবান্নার পানি আনতে হয় অনেক দূর থেকে। লোনাপানির দাপটে উপকূলীয় এলাকায় খাওয়ার পানির সংকট তীব্র। আর এ অভাব মেটাতে স্থানীয়ভাবে অনেকেই ভূগর্ভস্থ পানি তুলে তা পরিশোধন করে সরবরাহ করেন। বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি পানির ফিল্টার থেকে খাওয়ার পানি নিতে প্রতি মাসে হাজার টাকার কাছাকাছি ব্যয় করতে হয়। উপকূলজুড়ে বেসরকারি খাতের এ উদ্যোগ রমরমা। তাঁদের কাছ থেকে মানুষকে চড়া মূল্যে পানি কিনতে হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের ঋতু পরিবর্তিত হচ্ছে, আর এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে নিরাপদ ও সুপেয় পানির ওপর। গরম বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তীব্র হচ্ছে নিরাপদ খাওয়ার পানির সংকট। গ্রীষ্ম কালে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। নদ নদী শুকিয়ে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বাড়ছে। আগে উপকূলের ভূগর্ভের ৬০/৭০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া গেলেও এখন ১০০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যাচ্ছে। চলতি বোরো মৌসুমে সেচ পাম্পের আওতায় চাষ হওয়া কয়েক হাজার একর জমির বোরো ধানের আবাদ হচ্ছে। নদীর পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকেরা সেচের জন্য ক্রমেই গভীর ও অগভীর নলকূপনির্ভর হয়ে পড়ছেন। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অনিয়ন্ত্রিত চিংড়ি চাষ, চিংড়িঘেরে উঁচু বাঁধ না দেওয়া, নদীপ্রবাহ আটকে দেওয়া, পুকুর ভরাট, খাল বেদখলের কারণে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষগুলো নিরাপদ পানির তীব্র সংকটের মধ্য দিয়ে দিনানিপাত করছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধি ইতিমধ্যে বড় ভাবনার বিষয়।
পৃথিবীর মোট পানির ৯৭ শতাংশই লবণাক্ত, আমাদের জন্য ব্যবহারযোগ্য পানির পরিমাণ মাত্র ৩ শতাংশ। কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই নিরাপদ পানির সমস্যা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে-সব সংকট বাড়ছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম সুপেয় ও ব্যবহারযোগ্য পানির সংকট। পৃথিবীর প্রায় অর্ধ মিলিয়ন মানুষ সারাবছরে গুরুতর পানির সংকটের মুখোমুখি হয়। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশই সুপেয় পানি পানের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আর মৌলিক স্যানিটেশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত ৪৬ শতাংশ মানুষ। বিশ্বে প্রতি ৪ জন মানুষের একজন নিরাপদ পানির অভাবে ভুগছে। পানিতে জীবাণু, আর্সেনিক ও লবণাক্ততা রয়েছে। সারা বিশ্বই এখন নিরাপদ খাবার পানির সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
ভূগর্ভস্থ পানি অদৃশ্য সম্পদ। মানবসভ্যতার বিকাশ, সমৃদ্ধি ও বিবর্তনে পানি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মানুষের মৌলিক অধিকারের ভেতর পানি অন্যতম। দেশের ৪১ শতাংশ মানুষ এখনো নিরাপদ পানি সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বাড়িতে নিরাপদ স্যানিটেশন সুবিধা পায় না ৬১ শতাংশ মানুষ। দুর্গম এলাকা, গ্রামাঞ্চল ও শহরের বস্তি এলাকায় নিরাপদ পানি সহজে পাওয়া যায় না। অপেক্ষাকৃত ছোট শহরের মানুষকে বড় শহরের চেয়ে বেশি দামে পানি নিতে হয়। একটা ন্যায্যতা এ ক্ষেত্রে দরকার। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, অপর্যাপ্ত বাজেট, সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা ও অসচেতনতার কারণে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের সুবিধা থেকে এখনো দূরে এই মানুষেরা।
বর্তমানে বিশ্বে আনুমানিক ২৬০টি আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে। বিশ্বের প্রায় ৪০ ভাগ লোক এই আন্তর্জাতিক নদীগুলোর অববাহিকায় বসবাস করে। পানির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পানি নিচের দিকে গড়ায় এবং দেশের রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক সীমানা মানে না, এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যায়। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে পানি বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী ও দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিবাদ এবং যুদ্ধবিগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানির সংকট একটি বৈশ্বিক সংকট। যতোই দিন যাচ্ছে এ সংকট আরো তীব্র হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে নিরাপদ ও সুপেয় পানির এই সংকট মোকাবিলায় সরকার, সহযোগী উন্নয়ন সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়ে আমাদের প্রয়োজন সচেতনতা। পানির অপচয় রোধ ও পরিমিত ব্যবহারে আশপাশের মানুষকে সচেতন করে তোলা, পানির পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা, ভূগর্ভস্থ পানি রক্ষা করতে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করা। কাজেই এ সমস্যা মোকাবেলা করতে হলে পানির অপচয় রোধ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: প্রকাশ ঘোষ বিধান; সাংবাদিক ও কলামিস্ট