ইসলামের পরিভাষায় মুনাফিকের পরিচয়

মুফতী মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী : | প্রকাশ: ২৫ মার্চ, ২০২৫, ০৭:৫৬ পিএম
ইসলামের পরিভাষায় মুনাফিকের পরিচয়

মুনাফিকরা সমাজের বাইরের কেউ নয়। এরা সমাজের মধ্যেই বসবাস করে। যেকোনো ধর্মের পরিচয়েই সমাজে চলে এবং দৃষ্টিগত ধর্মের আনুষ্ঠানিকতায়ও অংশ নিয়ে থাকে। সামাজিকতায় হাট-বাজার ও একসাথেই ঘোরাফেরা। মুনাফিক মানবতার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই আল্লাহ সোবহানাহু তা'য়ালা এদের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা কোরআনুল কারীমে বিভিন্ন সূরার আয়াতে বলে দিয়েছেন। যাতে করে সচেতন ব্যক্তিরা সহজেই এদেরকে চিহ্নিত করতে পারে এবং এদের থেকে সতর্ক থাকতে পারে। অর্থাৎ মুনাফিক লোকগুলো মুখে বলার সাথে অন্তরের বিশ্বাস বদ্ধমূল এক নয়। মূলত মুনাফিক সবসময় মানুষের সাথে প্রতারণা করেই চলে। বাস্তবতা হচ্ছে তারা অন্য কাউকে নয়, নিজেদেরই ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। তাদের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো, ছলনাময় মিথ্যা কথা বলে মানুষ থেকে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা হাসিল করার চেষ্টা করে। যে সৎকাজ করে সে তার নিজের কল্যাণের জন্যেই করে আবার যে ব্যক্তি কোনো অন্যায় কাজ করে তার শাস্তিও তাকেই ভোগ করতে হবে। 


কুরআনুল মাজীদে শতাধিক আয়াতে মুনাফিকদের বিষয়ে আলোচনা এসেছে। তাছাড়াও কুরআনুল কারীমে মুনাফিকদের নামে একটি সূরাও রয়েছে। ‘‘চারটি স্বভাব যার মধ্যে বিদ্যমান সে হবে প্রকৃত মুনাফিক। যার মধ্যে এর কোনো একটি স্বভাব থাকবে, তা পূর্ণভাবে পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকের একটি স্বভাব থেকে যায়। সেগুলো হলো: ১. সম্পদ গচ্ছিত রাখা হলে তা হনন করে; ২. কথা বলালে মিথ্যা বলে; ৩. অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে; ৪. বিবাদে লিপ্ত হলে বিস্ফোরিত হয় (ফাজারা) অশ্লীল গালি দেয়, সত্য থেকে বিচ্যুত হয়, অত্যন্ত অবিবেচক, অযৌক্তিক, মূর্খ, মন্দ এবং অপমানজনকভাবে আচরণ করে।’’ আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ’আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ’’মুনাফিকের চিহ্ন হল তিনটি, ১। কথা বললে মিথ্যা বলে, ২। ওয়াদা করলে তা খেলাপ (রক্ষা করেনা) করে, ৪। আমানত রাখা হলে তাতে খিয়ানত (হনন) করে।’’ অন্য এক বর্ণায় আছে, ‘‘যদিও সে রোযা রাখে এবং নামায পড়ে ও ধারণা করে যে, সে মুসলিম’’(সহীহুল বুখারী ৩৩, ২৬৮২, ২৭৪৯, ৩১৭৮, মুসলিম ৫৮, তিরমিযী ২৬৩২, নাসায়ী ৫০২০, আবূ দাউদ ৪৬৮৮, আহমাদ ৬৭২৯, ৬৮২৫, ৬৮৪০)। সর্বজনীনতায় মুনাফিকের আলামতসমূহ: ব্যাধিগ্রস্ত মন, খেয়াল-খুশির প্রলোভন, অহংকার প্রদর্শন, দোটানা-দোদুল্যমান মনোভাব, মিথ্যা শপথ, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, কাপুরুষতা-অস্থিরতা, যা করেনি তা করার নামে প্রশংসা পিয়াসী, সৎকর্মকে দূষণীয় গণ্য করা, নিম্নতম অবস্থানে খুশী, অন্যায়ের আদেশ ও ন্যায়ের নিষেধ, মানুষের দৃষ্টির আড়াল হওয়ার চেষ্টা, আমানতের খেয়ানত করা, কথোপকথনকালে মিথ্যা বলা, অঙ্গীকার করে ভঙ্গ করা এবং বাকবিতণ্ডাকালে বাজে কথা বলা ও কুরুচিপূর্ণ বচন-বাচালতা। 


মুনাফিকরা সমাজের সরলমনা মানুষ ও ধার্মিক ব্যক্তিদেরকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য দরবেশের মতো পোশাক পরিধান করে থাকে। তাদের বেশ ভুষা দেখলে মনে হবে এ ব্যক্তি নিশ্চয় ভালো মানুষ এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দা। ধর্মীয় পোশাক বলতে যা বুঝায় তা তারা যথাযথভাবেই পরিধান করে। ধর্মীয় পোশাক দেখে বুঝার কোন উপায় থাকে না যে, তারাই প্রকৃত মুনাফিক। তারা কথার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত মিষ্টি মধুর কথা বলে। কথা শুনলে মনে হবে এই মানুষের দ্বারা কোনো পাপ কাজে লিপ্ত হওয়া অসম্ভব। আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল মাজীদে এদের ধরণের কথা উল্লেখ করে বলেন- ‘তুমি যখন তাদের দিকে তাকাবে তখন তাদের (বাইরের) দেহাবয়ব তোমাকে খুশি করে দেবে আবার যখন তারা তোমার সাথে কথা বলবে তখন তুমি (আগ্রহভরে) তাদের কথা শুনবেও’ (সুরা মুনাফেকুন, আয়াত-৪)। মুনাফিকদের চিহ্নিত করণে তাদের বাইরের এই রূপ দেখে যেন মানুষ প্রতারিত না হয় সে জন্য আল্লাহ তা'য়ালা তাদের বৈশিষ্ট্য বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। মুনাফিকের পরিচয় বর্ণনা করতে গিয়ে রাব্বুল আ'লামীন বলেন, ‘অবশ্যই মুনাফিকরা আল্লাহ তা'য়ালাকে ধোঁকা দেয়, (মূলত এর মাধ্যমে তিনিই আল্লাহ) তাদের প্রতারণায় ফেলে দিচ্ছেন, এরা যখন নামাজে দাঁড়ায় তখন একান্ত আলস্য ভরেই দাঁড়ায় তারা কেবল লোকদের দেখায়। এরা আল্লাহ তা'য়ালাকে কমই স্মরণ করে’ (সুরা নিসা, আয়াত-১৪২)। মুনাফিকের দল নিজেরা সবসময় পাপ কাজ, অন্যায় কাজের মাঝে ডুবে থাকে। অপরের সম্পদ জোর করে ভোগ দখল করে। তারা দুর্বল মানুষের ওপর প্রতিপত্তির জোরে অবিচার করে। তাদের কাছে কেউ যখন কোনো পরামর্শের জন্য আসে তখন তারা তাদেরকে সুপরামর্শের বদলে কুপরামর্শ দেয়। তাদের কাছে যখন কোন অভাবী, গরিব, মিসকিন সাহায্যের জন্য হাত বাড়ায় তখন তারা দান খয়রাত করে না। তারা এতিমের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে না। কোরআনে মুনাফিকদের আরো কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ্য করে বলেন, ‘মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী এরা একে অপরের মতোই তারা অসৎকাজের আদেশ দেয় ও সৎকাজ থেকে বিরত রাখে এবং (আল্লাহতায়ালার পথে খরচ করা থেকে) উভয়েই নিজেদের হাত বন্ধ করে রাখে’ (সুরা তাওবা, আয়াত-৬৭)। নিজের সুবিধা লুটতে মানুষের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করার জন্য সর্বদা ওঁৎ পেতে থাকে। আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত এই সমস্ত মুনাফিকদের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করেছেন এবং তিনি তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন তারা মুনাফিকদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা না করে। মহান আল্লাহ বলেন- ‘তুমি এদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো কিংবা না করো (এ দু-টোই) তাদের জন্য সমান। (কারণ) আল্লাহ তা’য়ালা কখনোই তাদের ক্ষমা করবেন না; আল্লাহ তা'য়ালা কোনো নাফরমান জাতিকে হেদায়েত দান করেন না’ (সুরা মুনাফেকুন, আয়াত-৬)। 


মুনাফিকদের শাস্তির ঘোষণা দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন- ‘আল্লাহ তা’য়ালা মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী এবং কাফেরদের জাহান্নামের ভয়াবহ আগুনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যেখানে তারা চিরকাল থাকবে’ (সুরা তাওবা, আয়াত-৬৮)। জাহান্নাম এমন একটি ভয়াবহ জায়গা যা বর্ণনা করে কোনো মানুষকে বুঝানো সম্ভব নয়। জাহান্নামীদের খাবার দেওয়া হবে গলিত রক্ত, পুঁজ এবং কাঁটাযুক্ত ফল এবং তাদেরকে পান করতে দেওয়া হবে ফুটন্ত গরম পানি; যা তাদের নাড়ি ভুঁড়িকে ছিঁড়ে দিবে। আল্লাহতায়ালা মুনাফিকদেরকে এমন ভয়াবহ আজাবের স্থান জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন এবং তারা সেখানে চিরদিন অবস্থান করবে। সেখানে তাদের অবস্থা এমন হবে যে, তারা মৃত্যু কামনা করবে কিন্তু তাদেরকে মত্যু দেওয়া হবে না। আল্লাহতায়ালা মানুষের অপরাধ অনুপাতে তাদেরকে জাহান্নামের বিভিন্ন স্তরে রাখবেন। এক্ষেত্রে মুনাফিকদের স্থান হবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন- ‘এ মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে, তুমি সেদিন তাদের জন্যে কোনো সাহায্যকারী খুঁজে পাবেনা’ (সুরা নিসা, আয়াত-১৪৫)। 


বিভিন্ন স্বভাবের সমষ্টি মানুষের মাঝে আছে, যা প্রশংসনীয় এবং নিন্দনীয়। আল্লাহ সোবহানাহু তা’য়ালা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিন্দনীয় স্বভাবগুলো থেকে বেঁচে থাকার জন্য শ্বাশত মহাগ্রন্থ কুরআনুল কারীম ও হাদীসে নববীতে কঠিন হুঁশিয়ারি বাক্যচারণ করেছেন। তার মধ্যে সবচাইতে নিন্দনীয় ও নিম্নমানের স্বভাব হলো মুনাফিকী। সেজন্যেই জনসচেতনতায় ইসলামের পরিভাষায় মুনাফিকের পরিচয় তুলে ধরা। অতএব আমরা যাতে করে মুনাফিকী স্বভাব হতে মুক্ত থেকে মানুষের কল্যাণ ও নির্মল সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে আত্মনিয়োগ করতে পারি আল্লাহ সোবহানাহু তা’য়ালার দরবারে রাউফুর রাহীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার সদকায় সাহায্য প্রার্থনা করি। 

লেখক: মুফতী মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী; প্রধান সমন্বয়ক, বাংলাদেশ সোস্যাল অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW
আপনার জেলার সংবাদ পড়তে