নওগাঁর মহাদেবপুরে থামছেইনা চাঁদাবাজি। সাংবাদিকতার নাম করে একের পর এক নতুন নতুন কৌশলে চলছে এ কাজ। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই অপকর্ম থামাতেই পারছেন না কেউ। বরং সংশ্লিষ্টরা প্রকাশ্যে তাদের শেল্টার দিয়ে চাঁদাবাজিকে আরো উৎসাহিত করছেন বলে মত স্থানীয়দের। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় দিনের পর দিন বেপরোয়া হয়ে পড়েছে তারা। ব্যবস্থা নিচ্ছে না পুলিশ, না কোন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী। সাংবাদিকতার আইডি কার্ড ব্যবহার করে এরা প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করছে, থানায় নানা বৈঠক পরিচালনা করছে, আবার অংশ নিচ্ছে উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায়ও। থানা পুলিশ, আইন-শৃঙ্খলা কমিটি, রাজনৈতিক দলের নেতা প্রমুখ তাদের প্রকাশ্যে মদদ দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব অপকর্মের সাথে জড়িতদের মধ্যে অন্যতম উপজেলা কৃষক লীগের নেতা এশিয়ান টিভির মহাদেবপুর প্রতিনিধি মোখলেছুর রহমান, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর মহাদেবপুর সদর কেন্দ্র পরিচালনা কমিটির প্রধান ও স্থানীয় একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুলের অধ্যক্ষ দৈনিক যুগান্তরের মহাদেবপুর প্রতিনিধি আইনুল হোসেন, ওই নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সহযোগি ও গত ৫ আগস্টের আগের দিন পর্যন্ত উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের বারান্দায় বসে থেকে পাহারা দেওয়া, ভারতের স্কন মন্দিরে গিয়ে সেলফি তুলে নিজের ফেসবুক আইডিতে পোষ্ট দেয়া দৈনিক আমার সংবাদ ও দৈনিক নতুন প্রভাতের মহাদেবপুর প্রতিনিধি বরুণ মজুমদার, আওয়ামী লীগের প্রয়াত এমপি ড. আকরাম হোসেন চৌধুরির প্রেস সচিব বলে পরিচিত দৈনিক আজকের বসুন্ধরার মহাদেবপুর প্রতিনিধি আককাস আলী, এনজিও কর্মী কথিত সাংবাদিক জুয়েল মন্ডল প্রমুখ।
মহাদেবপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী মান্দা উপজেলার মিরপুর গ্রামের পিয়ার বক্স মন্ডলের ছেলে বিরাজ উদ্দিন মন্ডল অভিযোগ করেন যে, তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে নিয়মানুযায়ী লাইসেন্স নিয়ে একটি ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে দাঁতের মাজন ও টাইগার বাম তৈরি করে গ্রামে গ্রামে হাটে বাজারে বিক্রি করে আসছেন। খবর পেয়ে গত ঈদের দুদিন আগে ২৯ মার্চ মহাদেবপুর থেকে কথিত সাংবাদিক আইনুল হোসেন, মোখলেছুর রহমান, জুয়েল মন্ডল ও মান্দার সাংবাদিক সবুজ হোসেন সেখানে উপস্থিত হয়ে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। অন্যথায় তাকে ব্যবসা করতে দিবেনা বলে হুমকি দেয়। পরদিন থেকে চাঁদার টাকার জন্য বার বার মোবাইলফোনে হুমকি দেয়। এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুটি কল রেকর্ড ফাঁস হয়। এর একটিতে কথিত সাংবাদিক মোখলেছুর রহমান ও আইনুল হোসেন ৫ জন সাংবাদিকের নাম করে ১০ হাজার টাকা দাবি করে। অন্যটিতে মান্দার সাংবাদিক আমজাদ সেখানে উপস্থিত না থাকলেও কিংবা তাদের সাথে কোন যোগাযোগ না থাকলেও আমজাদের নাম কেন বলা হয়েছে সে বিষয়ে মোখলেছুর রহমানকে জেরা করা হয়। তারা ঘটনার বিষয়ে নিউজ না করে কেন টাকার দাবি করলো সে বিষয়েও জেরা করা হয়।
এর ৫ দিন আগে গত ২৪ মার্চ মহাদেবপুর উপজেলার সদর খাদ্যগুদামে ঈদপূর্ববর্তী চাঁদার টাকা নিতে গেলে গুদামের কর্মচারি ও স্থানীয়রা কথিত সাংবাদিক বরুণ মজুমদার ও সাংবাদিক আককাস আলীকে আড়াই ঘন্টা আটক করে রাখে। এসংক্রান্ত একটি লাইভ ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
গতবছর ১৬ ডিসেম্বর উপজেলার বেহুলাতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মহান বিজয় দিবসের ছুটির দিনে দুজন নারী শিক্ষক বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকায় কথিত সাংবাদিক আইনুল হোসেন, মোখলেছুর রহমান, বরুণ মজুমদার ও আরো এক সাংবাদিক প্রধান শিক্ষককে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে এক লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করে। পরে প্রধান শিক্ষক তাদেরকে ৫ হাজার টাকা দেন। কিন্তু বাকি টাকা না দিলে এসংক্রান্ত খবর লেখার ভয় দেখায়। প্রধান শিক্ষক মুকুল চন্দ্র মন্ডল এব্যাবাপারে মহাদেবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কে বিষয়টি জানিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন জানান। এবিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
এছাড়া প্রয়াত ড. আকরাম হোসেন চৌধুরি নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর-বদলগাছী) আসনের এমপি থাকার সময় আককাস আলীর বিরুদ্ধে ব্যাপক চাঁদাবজির অভিযোগ করা হয়। তার বিরুদ্ধে ‘এমপির প্রেস সচিব পরিচয়ে চাঁদাবাজি : থানায় একের পর এক জিডি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এসময় আককাস আলী একটি ক্লিনিকে গিয়ে চাঁদার ৫ হাজার টাকাসহ হাতেনাতে পুলিশের হাতে আটক হয়ে দীর্ঘদিন হাজতবাস করে। পুলিশ মামলাটির চার্জশীট দেয়ার পর বিচার শুরু হলে রাজনৈতিক মামলা হিসেবে তা প্রত্যাহার করা হয়।
এসব চাঁদাবাজির একটিরও কোন ব্যবস্থা হয়নি। মান্দার বিরাজ উদ্দিন চাঁদাবাজির বিষয়ে মান্দা থানায় গেলে পুলিশ চাঁদাবাজি মামলা নিতে অস্বীকার করে। এখন তিনি কোর্টে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জানতে চাইলে মান্দা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মনসুর রহমান জানান, হুমকি দানের মামলা নেয়া হবে। মহাদেবপুর খাদ্যগুদামে চাঁদাবাজির বিষয়ে এখন পর্যন্ত থানায় কোন মামলা হয়নি। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জানান, ঈদের দীর্ঘ ছুটির কারণে মামলার প্রস্তুতি নিতে দেবি হচ্ছে।
এসব কথিত সাংবাদিকদের প্রায় প্রতিদিনই মহাদেবপুর থানা চত্ত্বরে বিভিন্ন জনের মামলার তদ্বির ও বৈঠকে উপস্থিত থেকে দালালি করতে দেখা যায়। মহাদেবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শাহীন রেজা জানান, কেউ নিজের থেকে থানা চত্ত্বরে উপস্থিত হলে তাকে নিষেধ করা যায়না। এদের মধ্যে মাত্র দুজন করে সদস্য নিয়ে বরুণ মজুমদার কথিত মহাদেবপুর ডিজিটাল প্রেসক্লাব ও আককাস আলী উপজেলা প্রেসক্লাব গঠন করে প্রতি মাসে উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় উপস্থিত থাকে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে বার বার জানালেও তাদেরকে কমিটির সদস্যপদ থেকে বাদ দেয়া হয়নি। জানতে চাইলে মহাদেবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি মো: আরিফুজ্জামান তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানাতে বলেছেন। কিন্তু জানানোর পরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এসব সাংবাদিক আওয়ামীপন্থি হলেও উপজেলা কৃষক দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে, এমনকি এই দলের কেন্দ্রীয় নেতার তাদের নিয়ে একান্ত আলাপচারিতায় লিপ্ত হতেও দেখা গেছে। মহাদেবপুর উপজেলা খাদ্যগুদামে চাঁদাবাজি করতে যাওয়া কথিত সাংবাদিকদের এরাই উদ্ধার করে।