সরাইলে ভূমিদস্যুদের হুমকিতে গ্রাম ছাড়া হাজেরা

এফএনএস (মাহবুব খান বাবুল; সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) : : | প্রকাশ: ৮ ডিসেম্বর, ২০২৪, ০২:০৯ এএম : | আপডেট: ৫ জানুয়ারী, ২০২৫, ১২:৩৫ পিএম
সরাইলে ভূমিদস্যুদের হুমকিতে গ্রাম ছাড়া হাজেরা

১৩ বছর আগে পাওয়া সরকারি ৩৮ শতক জায়গাই কাল হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের অরূয়াইলের ধামাউড়া গ্রামের হাজেরার। নতুন করে ভূয়া পরিচয় দিয়ে জায়গায় থাবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন প্রয়াত মধু মিয়ার ছেলে কফিল উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি। গত ৫ই আগষ্টের পর হঠাৎ জায়গাটি কেড়ে নিতে সক্রিয় হয়ে উঠে একটি ভূমিদস্যু চক্র। কৌশলে সামনে আনে এক কিলোমিটার দূরের একটি মসজিদকে। স্থানীয় ভূমিদস্যুদের হুমকি ধমকি ভয়ভীতি হামলা মামলার কারণে গত ৪ মাস ধরে গ্রাম ছাড়া বিধবা হাজেরা। অসহায় দরিদ্র হাজেরা সন্তানদের নিয়ে যাযাবরের মত জীবন যাপন করলেও বিষয়টি নিস্পত্তির কোন উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেউ। দখলদার বিরূদ্ধে প্রতিবাদ করে অনেক পরিবারকে হরহামেশা পড়তে হচ্ছে প্রতিপক্ষের রোষানলে। রাস্তা হাটবাজারে যাওয়া বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগও উঠেছে। এর প্রতিবাদে ধামাউড়া গ্রামে মানববন্ধনও করেছেন ভুক্তভোগী ২০-২২ পরিবারের সদস্যরা। একটি জাল দলিল তৈরীর কথাও চাউর হচ্ছে গোটা অরূয়াইলে। আর পুলিশ বলছেন হাজেরার প্রতিপক্ষ খুবই শক্তিশালী। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বলছেন দরিদ্র দূর্বল বলে কী সত্যে থেকেও ন্যায় বিচার পাবেন না হাজেরা? এমন প্রশ্ন শুধু ধামাউড়া গ্রাম নয়, অরূয়াইলের অনেকেরই। সরজমিন অনুসন্ধানে ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, প্রায় ১৩ বছর আগে ধামাউড়া গ্রামের ভূমিহীন রহমত আলী আবেদন করে সরকারি ৩৮ শতক জায়গা ইজারা পান। গত ৮ বছর আগে রহমত আলী মারা যান। সম্প্রতি তার বিধবা স্ত্রী হাজেরা বেগম ওই জায়গা দখলে নিয়ে সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছিলেন। মাটি ফেলে ভরাট করায় জায়গার সৌন্দর্য ও মূল্য বেড়ে গেছে। এতেই কপাল পুড়েছে হাজেরার। ওই জায়গার উপর লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে স্থানীয় একটি ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের। তারা গত ৫ই আগষ্টের পর জায়গা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের একটি মসজিদের কথা বলে মাঠে নামেন। কোন কাগজপত্র ছাড়াই জায়গাটির অংশ বিশেষ  ধামাউড়া শাহী জামে মসজিদের বলে দাবী তুলেন। মসজিদকে সামনে ধরে ফুসলাতে থাকেন গ্রামবাসীকে। কৌশলে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন দরিদ্র হাজেরার উপর। কাগজে টিপসহি বা স্বাক্ষর দিতে হাজেরাকে দিনেরাতে চাপ দিতে থাকেন। এতে কাজ না হওয়ায় হাজেরাকে দেয়া হয় মারধর করার হুমকি ধমকি। কাহিল করতে হাজেরার বিরূদ্ধে দেয়া হয় সাজানো একাধিক মামলা। জীবন বাঁচাতে অন্যের বাড়িতে বসবাসকারী হাজেরা ঘরে তালা দিয়ে পালিয়েছেন গ্রাম ছেড়ে। হাজেরার ওই জায়গায় এখন মিথ্যা ভূয়া পরিচয়ে থাবা দিতে এগিয়ে এসেছেন ধামাউড়া গ্রামেরই মো. কফিল উদ্দিন। গ্রামের বাসিন্দা মো. রজব আলী (৭৮), মোর্শেদ মিয়া (৭০), হিরা মিয়া (৬৫), হারূন মিয়া (৬০), সাবেক ইউপি সদস্য মো. হাবিব উল্লাহ, মহিলা ইউপি সদস্য মোছা. মালেকা বেগম, জাহেদ মিয়া ও পুতুল বেগমসহ অনেকেই অভিযোগ করে বলেন,  বিএনপি নেতা সোহেল ভূঁইয়া, মানিক মিয়া, সামছু মেম্বার, তাজু মিয়া ও মোখলেছ মিয়ার নেতৃত্বে গ্রামে গড়ে উঠা একটি চক্রের লোলুপ দৃষ্টি পরে হাজেরা বেগমের জায়গার উপর। বল প্রয়োগের প্রতিবাদ করায় হাজেরার গোত্রের লোকজনকে নানা ভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। মাইকিং করে তাদেরকে রাস্তাঘাটে হাঁটে বাজারে অপমান অপদস্ত ও মারধর করা হচ্ছে। পথিমধ্যে মহিলাদেরও হেস্তনেস্ত করা হচ্ছে। ভয়ে প্রায় ২০ পরিবারের লোক গৃহবন্দি হয়ে পড়েছি। এদের বিরূদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পায় না। আমরা সকলেই কমবেশী তাদের অত্যাচারের শিকার। এখন আবার মাঠে নেমেছে কর্মহীন কফিল উদ্দিন। উপজেলা ভূমি অফিসে নিজেকে শাহী মসজিদের মুয়াজ্জিন লিখে কফিল উদ্দিন হাজেরার নামের লীজ বাতিলের জন্য লিখিত আবেদন করেছেন। তিনি জায়গাটি নিয়ে আসছেন বলে চাউর করে এলাকায় বিশৃঙ্খলা লাগানোর চেষ্টা করছেন। অথচ ওই মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা এনায়েত উল্লাহ বলেন, কপিল উদ্দিন নয়, গত ছয়মাস ধরে মসজিদের মুয়াজ্জিন ঢাকা গাজীপুরের আশিক। লীজ বাতিলের আবেদন করার কথা স্বীকার করে কফিল উদ্দিন বলেন, আমি বর্তমান নয়, সাবেক মুয়াজ্জিন। জায়গাটি সরকারি। অনেক আগে জায়গাটি জমা দিয়ে মসজিদের ফান্ডে টাকা রাখতাম। মৌখিকভাবে কিছু লোক জায়গাটি মসজিদকে দান করেছিল। তবে কোন কাগজপত্র নেই। এই কাজে আমার পেছনে গ্রামের আরো ৮-৯ জন গণ্যমান্য লোক আছেন। মসজিদ কমিটির সভাপতি সম্পাদক রেখে আপনি আবেদন করলেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে নীরব থাকেন কফিল। কিছুক্ষণ পর বলেন আমাদের কারো ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ নেই। শুধু মসজিদের জন্য চেষ্টা করছি। শুনেছি কারো কাছে একটি দলিল নাকি আছে। হাজেরা বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমার প্রয়াত স্বামী ১৩ বছর আগে খেয়ে না খেয়ে লোকজনের দ্বারে দ্বারে ঘুরে সকরকার থেকে জায়গাটি এনেছেন। এবার সরকার পতনের তাজু, সামছু, মানিক , কফিল ও লিটনসহ একটি গ্রƒপ জায়গাটি নিতে উঠে পড়ে লেগেছে। টিপসহি নিতে গভীর রাতে দলবেঁধে ঘরে আসে। দেয়নি তাই মারধর হুমকি ধমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে চলে। বাধ্য হয়ে জীবন বাঁচানোর জন্য আমি ৪ মাস আগে গ্রাম ছেড়েছি। তারা জায়গার জন্য আমাকে মেরেও ফেলতে পারে। আমার গোত্র ও স্বজনদের উপর রাস্তা ঘাটে অবিচার নির্যাতন করছে। আমি সন্তানদের নিয়ে স্বামীর ওই জায়গাটায় শান্তিমত থাকতে চাই। গ্রামে ফিরে যেতে চাই। আমি বাঁচতে চাই। গ্রামবাসী ও প্রশাসনের কাছে আমি জীবনের নিরাপত্তা চাই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে গ্রামের একাধিক ব্যক্তি বলেন, মসজিদকে শো করেছে মাত্র। এখানকার ভূমিদস্যু একটি সিন্ডিকেট সরকার পরিবর্তনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে দরিদ্র হাজেরার জায়গাটি জোর করে নিতে চাচ্ছে। তারা কে কত শতক নিবেন? কত টাকা বিক্রি করলে কত টাকা ভাগে পড়বে? তা ফয়সালা করে মামলা পরিচালনার খরচের কথা বলে মসজিদ থেকে টাকা নিয়ে নেমেছেন। তাদের উদ্যেশ্য মোটেও ভালো না। এই জায়গাকে কেন্দ্র করে হতাহতের ঘটনা ঘটারও সম্ভাবনা আছে। স্থানীয় মহিলা ইউপি সদস্য মালেকা বেগম বলেন, দুই পক্ষের উত্তেজনা নিস্পত্তির লক্ষ্যে আমি থানায় গিয়ে তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা বর্তমান অফিসার ইনচার্জ রফিকুল হাসান স্যারকে আপোষ মিমাংসার চেষ্টার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। একজন পুলিশ কর্তকর্তা বললেন সামছু, কফিল, তাজু, মানিক গংরা থানায় আসবে না। সরাইল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. রফিকুল হাসান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, হাজেরা বেগম খুবই অসহায়। আমরা মসজিদ কমিটি ও সংশ্লিষ্টদের থানায় ডেকেছিলাম। উনারা আসেননি। আবারও চেষ্টা করছি। অন্যথায় আইনগত ব্যবস্থা নিব। আর হাজেরা বেগমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নিজ গ্রামের আবাসস্থলে বসবাসের সুযোগ করে দিব। 

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW
আপনার জেলার সংবাদ পড়তে